পরিস্থিতি আসলে
‘স্বাভাবিক’ হচ্ছে না
by -
Ashik ぁ
on -
Monday, August 13, 2018
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদেরআন্দোলনের অবসানের পর ঢাকা এবং দেশ যেপূর্বাবস্থায় ফিরে এসেছে, তার একটি জ্বলন্তউদাহরণ হচ্ছে শুক্রবার রাত সোয়া নয়টার দিকেস্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গাড়িতে লোকাল বাসেরধাক্কা দেওয়ার ঘটনা। আর এই দুর্ঘটনা ঘটেছেতখন, যখন চলছে ট্রাফিক সপ্তাহ। পথে পথেপুলিশের উপস্থিতি এবং লাইসেন্স পরীক্ষারমধ্যেই বাসচালকের সহকারী, যাঁর ড্রাইভিংলাইসেন্সই ছিল না, তাঁর চালানো বাস ধাক্কাদিয়েছে মন্ত্রীর গাড়িকে। সৌভাগ্যবশত মন্ত্রীআসাদুজ্জামান খান আহত হননি, গাড়ির ক্ষতিওসামান্যই। দুর্ঘটনা ঘটা কোনো বিচিত্র বিষয়নয়, অস্বাভাবিকও নয়; কিন্তু কোনো কোনোদুর্ঘটনা যে প্রতীকী হয়ে ওঠে, সেটা মনেরাখলে এই সামান্য দুর্ঘটনাটির তাৎপর্য বোঝাসহজ হবে। সময় ও কারণ দুই-ই লক্ষণীয়। ২৯ জুলাইদিয়া খানম মিম ও আবদুল করিম রাজীবের মৃত্যুযেমন পরিবর্তনের তাগিদের জন্য প্রতীকী হয়েউঠেছিল এবং গোটা দেশের মানুষের কাছেআবেদন রেখেছিল, শুক্রবারের দুর্ঘটনাও তেমনিপূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তনের এক প্রতীকী ঘটনা।শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ সবারজানা। যেভাবে এর অবসান হয়েছে, সে বিষয়েবিস্তারিত বলাও বাহুল্য। সহিংসতা এবং বলপ্রয়োগের কারণেই একটি ন্যায্য আন্দোলনেরইতি ঘটেছে। এর জন্য ‘গুজব’ রটনাকারীদের ওপরসমস্ত দায় চাপিয়ে দিয়ে যারা স্বস্তি ও তৃপ্তিবোধ করছেন, তাঁরা গুজব রটনার পরিস্থিতিরসূচনা কেন হলো, সেটা ভেবে দেখলে ভালোকরবেন। যাঁরা আন্দোলনের তৃতীয় দিন থেকেইতাঁদের অনিঃশেষ বিজ্ঞতা দিয়ে প্রায় দৈববাণীর মতো করে অত্যাসন্ন সহিংসতারভবিষ্যদ্বাণী করে আসছিলেন, তাঁরা কি এইসহিংসতা যাঁরা চালালেন, তাঁদের অনুকূলেইপরিবেশ তৈরি করেননি? একেই ইংরেজিতেবলে ‘সেলফ-ফুলফিলিং প্রফেসি’; বাংলায়সম্ভবত একে ‘স্ব-পূরক ভবিষ্যদ্বাণী’ বলে বর্ণনাকরতে পারি। ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত এক গবেষণাপ্রবন্ধে মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট মার্টনপ্রথম এই ধরনের আচরণের দিকে মনোযোগআকর্ষণ করেন এবং এই ধারণাটি চালু করেন।‘সেলফ-ফুলফিলিং প্রফেসি’র মোদ্দা কথাহচ্ছে গোড়াতে কোনো পরিস্থিতিকে এমনমিথ্যাভাবে বলা, যার ফলে এমন ধরনের আচরণসংঘটিত হয়, যা শেষ পর্যন্ত ওই মিথ্যাকেইসত্যে পরিণত করে। তাতে করে যে বা যাঁরা ওইমিথ্যার প্রচার করেছিলেন, তাঁরা এই কৃতিত্বনিতে পারেন যে সে বা তাঁরাই আসল অবস্থাবুঝতে পেরেছিলেন। এই ধরনের ‘প্রফেসি’সংকটকালে ‘গুজবের’ চেয়েও অনেক বেশিভয়াবহ হতে পারে, বিশেষ করে তা যদিক্ষমতাশালীদের অস্ত্র হয়ে ওঠে। কেউ কেউএকে ‘উসকানি’ বলেই বিবেচনা করতে পারেন।শিক্ষার্থীদের ঘরে ফেরার পরে এখন যেঅবস্থা, তাকে গণমাধ্যম এবং সোশ্যালমিডিয়ায় যাঁরা ‘স্বাভাবিক’ হয়ে আসা বলেবর্ণনা করছেন, তাঁরা আসলে বলতে চাইছেন‘পূর্বাবস্থা’। পূর্বাবস্থা যে স্বাভাবিক ছিল না,সেটা শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে দেখিয়েদেওয়ার পরেও যদি তা না বুঝতে সক্ষম হই তবেতাকে অপারগতা বলে মনে করার কারণ নেই,একে অনীহা বলাই ভালো। এটা বলা যথার্থ যে,নয় দিনের আন্দোলনের আগে রাস্তাঘাটের যেঅবস্থা ছিল, সড়ক পরিবহনের ব্যবস্থাপনায় যেঅবস্থা ছিল, আমরা সেখানেই ফিরে এসেছি।মনে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পথে নামা, দাবিউত্থাপন, আন্দোলন হচ্ছে ঘটনা কিংবাদুর্ঘটনামাত্র। একে যাঁরা একসময় ঐতিহাসিকবলেছিলেন, তাঁদের আচরণে মনে হয় এখন তাঁরাএকে ইতিহাসের ফুটনোটে পরিণত করতেবদ্ধপরিকর। ইতিমধ্যেই যে ধরনের প্রচারণাচালানো হচ্ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে পুরোআন্দোলনকেই কেবল ‘গুজবের’ ফসল বলা হলেওঅবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।অনেকে মনে করিয়ে দেবেন যে এক দিনে এতবড় সমস্যার সমাধান হবে না। আমিও তা আশাকরছি না। প্রশ্ন হচ্ছে লক্ষণগুলো কী? ইতিমধ্যেঅর্জনের তালিকার শীর্ষে আছে সড়ক পরিবহনআইন। এই আইন মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছেএবং সংসদে পাস হওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার।এই আইনের ফাঁকফোকর বোঝার জন্য এটাইযথেষ্ট মালিকদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হতে পারে-এমনকিছুই এতে নেই। মালিকদের প্রতিনিধিকেমন্ত্রিসভায় রেখে সেই সম্ভাবনা কতটুকু? অন্যবিষয়গুলোর মধ্যে যা আছে তাকে একধরনেরদায়মুক্তির ব্যবস্থাই বলা যায়। বাংলাদেশইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) নেতারাসংবাদ সম্মেলনে যা বলেছেন তা গুরুত্বপূর্ণ:“আইনটিতে…সড়কের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারিগরিব্যক্তি, বাসমালিক ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষেরব্যবস্থাপনাজনিত দায়মুক্তির সুযোগ রয়েগেছে” (বণিকবার্তা, ৯ আগস্ট ২০১৮)। গত কয়েকদিনে ঢাকায় বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্টঅথরিটির (বিআরটিএ) সামনে উপচে পড়াগাড়ির ভিড় দেখিয়ে যাঁরা একে সড়কনিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতার কিংবা আইনপালনে আগ্রহের উদাহরণ বলবেন, তাঁরা নিশ্চয়এটাও জানেন যে এই সুযোগে দালালদের আয়-রোজগার বেড়েছে (বিবিসি বাংলারপ্রতিবেদন, ৯ আগস্ট ২০১৮)। দালালদেরউপস্থিতি এবং চটজলদি কাগজপত্র নবায়নের এইপ্রক্রিয়া যে আবারও যথাযথ ব্যবস্থারঅনুপস্থিতিকে স্মরণ করিয়ে দেয় এবংমধ্যস্বত্বভোগীদের উপস্থিতি যে দুর্নীতিরইঙ্গিত দেয়, তা বিস্মৃত হওয়ার সুযোগ কোথায়?এই সব হচ্ছে আইনি দিক, আমলাতান্ত্রিক দিক।এর সঙ্গে কারিগরি এবং প্রযুক্তিগত বিষয় যুক্তকরা যায়। এই সব বিবেচনায় পূর্বাবস্থায়প্রত্যাবর্তনের ফলে হয়তো আগের চেয়ে বেশিক্ষতি হবে না। কিন্তু একে আর স্বাভাবিক বলেবিবেচনা করা যাবে না, সেটাই হচ্ছে এইআন্দোলনের শিক্ষা। যাঁরা এই পরিস্থিতিকে‘স্বাভাবিক’ বলে মনে করছেন, তাঁদের সঙ্গেআমার মতপার্থক্য কেবল ভাষাগত নয়। কেননা,আন্দোলন দমনেই কেবল শক্তি প্রয়োগ হয়েছে,তা নয়; এরপর যা ঘটছে তা আরও উদ্বেগজনক।ইতিমধ্যে আটক ২২ জন শিক্ষার্থীকে রিমান্ডেপাঠানোর ঘটনা ঘটেছে, তাঁদের জামিনেরআবেদন নাকচ করে জেলে পাঠানো হয়েছেএবং একসময়ের ছাত্রনেতা শিক্ষামন্ত্রীএককথায় তাঁদের মুক্তির সম্ভাবনা নাকচ করেদিয়ে আইনের নিজস্ব গতির দিকেঅঙ্গুলিসংকেত করেছেন।শুধু তা-ই নয়, লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায়প্রকাশিত প্রতিবেদন সূত্রে সারা পৃথিবীই এখনজানে যে ‘কাউকেই ছাড়া হবে না’ বলে হুংকারদিয়ে গুজব রটনাকারী অভিযোগে তরুণদেরসামাজিক মাধ্যম অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করাহচ্ছে। স্বীকার করতে চান অথবা না চান দেশেরবাইরে একে ‘উইচ হান্টিং’ বলেই মনে করাহচ্ছে। তরুণদের ভীতসন্ত্রস্ত করার যে কৌশলকোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধেপ্রয়োগ করা হয়েছে, এখন তা আরও ব্যাপকআকারে প্রযুক্ত হতে শুরু করেছে। এগুলো শক্তিপ্রয়োগের কৌশল। যে লাখ লাখ শিক্ষার্থীআন্দোলনে যুক্ত ছিল, তারা তাদের সমবয়সীশিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে এসব ব্যবস্থাকে‘স্বাভাবিক’ বলে মেনে নেবে-এমন মনে করারকারণ নেই। সেটা এখনই প্রকাশিত হোক অথবানা হোক। ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবিতেরাস্তায় নামা শিক্ষার্থীদের ওপর কয়েকটিজায়গায় যে হামলার ঘটনা ঘটেছে, তাতেমানসিক অসুস্থতায় ভুগছে বেশ কয়েকজনশিক্ষার্থী’-এই খবর বিবিসির। এই অবস্থায়আছে কত শিক্ষার্থী, আমরা তা জানি না। এরসঙ্গে এখন মানসিক চাপ, ভীতি এবং আতঙ্কছড়িয়ে দেওয়ার যে কৌশল, তাতে আপাততরাজনৈতিক সাফল্যই প্রধান বিবেচ্য।এ ধরনের শক্তি প্রয়োগ এবং কথিত আইনিব্যবস্থার প্রতিক্রিয়া দেশের বাইরে কী ধরনেরহয়, তা ইতিমধ্যেই শহিদুল আলমকে আটকেরপ্রতিক্রিয়া থেকেই বোধগম্য। যে প্রক্রিয়ায়তাঁকে আটক করা হয়েছে এবং আটক অবস্থায়তাঁর সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করা হয়েছে বলেতিনি অভিযোগ করেছেন, তার প্রতিক্রিয়ায়‘সড়ক নিরাপত্তা’ নয়, বাংলাদেশে বিরাজমানশাসনব্যবস্থা নিয়েই আলোচনা হচ্ছে।বাংলাদেশে ভিন্নমতের জায়গা যে কতটাসংকুচিত হয়েছে, সে বিষয়ে যাঁরা অবগতছিলেন না, তাঁদের মনোযোগ এখনবাংলাদেশের দিকে নিবদ্ধ হয়েছে, এটা এখনআর অস্বীকারের উপায় নেই।আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেটইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগেরডিস্টিংগুইশড প্রফেসর
0 Comments