বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৫ ফুটবল দলের তহুরা
খাতুনের জীবন বদলে দিয়েছে ফুটবল।
থিম্পুতে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ ফুটবল কভার করতে
যাওয়া প্রথম আলোর প্রতিনিধি
বদিউজ্জামান সেই গল্পটিই তুলে এনেছেন
‘আম্মু, ঢাকা কোথায়?’ ঢাকা থেকে গ্রামে নতুন
কেউ এলেই মেয়ের মুখে প্রশ্নটা শুনতে হতো
সাবিকুন নাহারকে। চেহারায় বিরক্তি থাকলেও
হাসিমুখে বলতেন, ‘ওরে বোকা, ঢাকা
বাংলাদেশের মধ্যেই।’ কিশোরী তহুরা খাতুন
ততক্ষণে কল্পনায় পাখা মেলে ঢাকায় ফুটবল
খেলতে চলে গেছে। মাকে লুকিয়ে ঢাকা থেকে
আসা আগন্তুককে কত দিন যে দেখতে গেছে
প্রতিবেশীদের বাড়িতে, তার ইয়ত্তা নেই! অথচ
তখনো বাড়ির পাশের ধোবাউড়া থানা কিংবা
ময়মনসিংহ শহরটাও চেনা হয়নি তহুরার। এটা বছর
ছয়েক আগের ঘটনা। ফুটবল খেলার সুবাদে সেই
তহুরার এত দিনে ঘোরা হয়ে গেছে নেপাল,
তাজিকিস্তান, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া,
জাপান, হংকং, ভুটানসহ কত দেশ!
মেয়েদের সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ ফুটবলে বাংলাদেশ
দলের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার তহুরা। ঢাকায়
সাফের এই টুর্নামেন্টের প্রথম আসরে গত বছর
নেপালের বিপক্ষে করেছিল হ্যাটট্রিক। এরপর
চোট তাকে খেলতে দেয়নি দুই ম্যাচ। ফাইনালে
অবশ্য অফসাইডের ফাঁদে পড়ে বাতিল হয়েছিল
তার গোল। গত মার্চে হংকংয়ে অনূর্ধ্ব-১৫ জকি
কাপে দুটি হ্যাটট্রিকসহ ৮ গোল করে সর্বোচ্চ
গোলদাতার পুরস্কার জিতেছিল। থিম্পুতে
চলমান সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ টুর্নামেন্টের প্রথম
ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে করেছে দুর্দান্ত
দুটি গোল। গত দুই বছরে আন্তর্জাতিক ফুটবলে এ
পর্যন্ত পাঁচটি হ্যাটট্রিক করেছে তহুরা। এএফসি
অনূর্ধ্ব-১৪ চ্যাম্পিয়নশিপ, অনূর্ধ্ব-১৬
চ্যাম্পিয়নশিপ, অনূর্ধ্ব-১৫ সাফ ও হংকংয়ের
জকি কাপ মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ২৭ গোল রয়েছে
তহুরার নামের পাশে। মেয়েদের বয়সভিত্তিক
ফুটবলে এত গোল করেনি আর কেউ!
তাজিকিস্তানে ২০১৬ এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪
আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে ৪ ম্যাচে করে
সর্বোচ্চ ১০ গোল। ওই টুর্নামেন্টে
বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ন করতে বড় ভূমিকা
ছিল কলসিন্দুরের কিশোরীর।
ফুটবল তাঁর রক্তে। ফুটবল খেলাটা নেশা। বাবা
ফিরোজ মিয়া চাইত না মেয়ে ফুটবলার হোক।
হাজিবাড়ির মেয়ে খেলবে ফুটবল? তবে ওই সময়
এগিয়ে এসেছিলেন বড় ভাই আশরাফুল ইসলাম।
মাদ্রাসাপড়ুয়া ভাই বাড়ি থেকে লুকিয়ে
তহুরাকে খেলতে নিয়ে যেতেন মাঠে। কাল
থিম্পুর চাংজিজি ফুটবল মাঠে দাঁড়িয়ে
পুরোনো দিনের স্মৃতি হাতড়াচ্ছিল তহুরা,
‘ভাইয়া আমাকে বলত, চল, ফুটবল খেলবি।
গ্রামের টুর্নামেন্টে দুই দলে খেলতাম দুজন।
দুজনে আবার ৫-১০ টাকা বাজিও ধরতাম।
বাজিতে কখনো জিততাম, কখনো হারতাম।’
ছেলেদের মতো চুলের ছাঁট তহুরার। এলাকায়
ছেলেদের সঙ্গেই মার্বেল খেলা, সাইকেল
চালানো, মাছ ধরা, পাখি শিকার, এমনকি
বাবার সঙ্গে মাঠে ধান লাগানোতেও জুড়ি
মেলা ভার তহুরার। এলাকার সবাই তাকে ‘মেসি’
বলে ডাকে। আর্জেন্টাইন তারকার সঙ্গে তুলনা
করায় কোথায় খুশি হবে, উল্টো ক্ষোভে ফেটে
পড়ত তহুরা, ‘শুরুতে সবাই যখন আমাকে মেসি বলে
ডাকত তখন আমি রেগে যেতাম। রাস্তা দিয়ে
হেঁটে গেলে লোকে বলত, মেসি কোথায় যাও?
সানজিদা, মার্জিয়ারাও মেসি বলে ডাকত।
অথচ তখনো আমি জানতাম না মেসি আসলে
কে!’ বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবল খেলতে প্রথম ঢাকায়
এলে তহুরার ‘মেসি-দর্শন’ ঘটে, ‘সবার মুখে
মেসির কথা শুনে আমার ভীষণ ইচ্ছে করত তাঁর
খেলা দেখতে। একদিন ইউটিউবে আমাকে
মেসির খেলা দেখাল মারিয়া। এরপর থেকে
মেসির ভক্ত হয়ে গেলাম।’
তহুরার প্রিয় ফুটবলার জাতীয় দলের স্ট্রাইকার
সাবিনা খাতুন। প্রথমবার সাবিনাকে দেখে
সেকি উচ্ছ্বাস তহুরার, ‘একবার বঙ্গমাতা
ফুটবলের উদ্বোধন করতে আমাদের এলাকায়
এসেছিলেন সাবিনা আপু। আমি স্যারকে গিয়ে
জিজ্ঞাসা করলাম, আপুর সঙ্গে কি আমি কথা
বলতে পারব? স্যার বলেছিলেন, অবশ্যই। এরপর
জাতীয় দলে সুযোগ পেয়ে যেদিন সাবিনা আপুর
সঙ্গে অনুশীলন করলাম, কী যে ভালো
লেগেছিল!’
তহুরার জীবনটাই বদলে দিয়েছে ফুটবল।
এলাকায় যারা আগে তাকে ফুটবল খেলতে
নিষেধ করত, এখন তারাই তহুরাকে আদর করে।
গ্রামে গেলে লোকে দেখতে আসে একনজর। শুধু
তা-ই নয়, ডেকে বলে, ‘তহুরা তোমার জন্যই
আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে।’
ফুটবল খেলে গ্রামটাকে আলোকিত করেছে
তহুরা, এবার চায় বাংলাদেশও আলোকিত হোক।

0 Comments