আশরাফুল, আশা নাকি হতাশা!



মোহাম্মদ আশরাফুলের ওপর থেকে জাতীয়
দল ও ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক ক্রিকেটে
খেলার নিষেধাজ্ঞা আজ উঠে যাচ্ছে।
আশরাফুল আগেই জানিয়েছেন ২০১৯
বিশ্বকাপ দিয়ে জাতীয় দলে ফেরার স্বপ্ন
দেখছেন তিনি। আশরাফুলের এই স্বপ্ন কতটুকু
বাস্তবসম্মত?
কে বলে ‘থার্টিন’ সবসময় ‘আনলাকি’? আজ ১৩
আগস্ট থেকেই তো আশরাফুলের ‘মুক্তি’! কিন্তু
মুক্তি কি আসলেই মিলবে? অমোচনীয় দাগ কি
তুলে ফেলতে পারবেন? পারবেন কি অতীত মুছে
আবার জাতীয় দলে ফিরতে?
আশরাফুলের জন্য আপাতত এই মুক্তি স্বস্তির।
এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলেন পাঁচ বছর। ম্যাচ
পাতানো ও স্পট ফিক্সিংয়ের শাস্তিটা উঠে
যাবে আজ থেকে। খুলবে জাতীয় দল ও
ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক ক্রিকেটে খেলার
দ্বার। ঘরোয়া ক্রিকেটের দুয়ার খুলেছে দুই বছর
আগেই। জাতীয় দলে খেলার আশা করার
সুযোগটা যেহেতু পাচ্ছেন, তাই ইংল্যান্ডে কাল
সকালটা আশরাফুলের জন্য নিশ্চিতভাবেই
অন্যরকম। অনুশীলনের জন্য এখন তিনি
ইংল্যান্ডে। আজ তাই অনুশীলনে ব্যাট হাতে
নিয়ে আশরাফুল নিশ্চিতভাবেই দেখতে পাবেন
বিশ্বকাপটা আরও কাছে!
বিশ্বকাপ? হ্যাঁ, নিষেধাজ্ঞা কাটার পর ২০১৯
বিশ্বকাপ দিয়ে জাতীয় দলে ফেরার স্বপ্ন
দেখছেন আশরাফুল। এক সময় জাতীয় দলের
অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হওয়া এ ব্যাটসম্যান
দেশের হয়ে সর্বশেষ খেলেছেন ২০১৩ সালে
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডেতে। এরপর পাঁচটি
বছর তো নিষেধাজ্ঞা কাটাতেই চলে গেল।
তাঁর বয়সও বসে নেই। চৌত্রিশ টপকে পা
রেখেছেন পঁয়ত্রিশে। এই বয়সে বিশ্বকাপে
খেলার স্বপ্নপূরণ হয়েছে অনেকেরই। কিন্তু
আশরাফুলের ক্ষেত্রে প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন।
একে তো জড়িয়েছিলেন স্পট ফিক্সিং আর
ম্যাচ পাতানোর বিতর্কে। ২০১৩ সালে প্রথম
আলোর এক
অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে বিপিএলে স্পট
ফিক্সিংয়ের ভয়ংকর সব দিকের কথা
। উৎপল শুভ্রের সে প্রতিবেদনের সূত্র ধরে
বেরিয়ে আসে, জাতীয় দলেও আশরাফুল স্পট
ফিক্সিংয়ে জড়িত ছিলেন। আন্তর্জাতিক
ক্রিকেটেও তিনবার স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িত
থাকার কথা আশরাফুল নিজে স্বীকার
করেছিলেন সে সময়। যদিও গতকাল প্রকাশিত
সাক্ষাৎকারে তাঁর দাবি,
দেশের সঙ্গে কোনো প্রতারণা করেননি
। ‘কিছু অন্যায়’ করেছেন, তবে জাতীয় দলকে
কখনো ইচ্ছা করে হারানোর মতো কিছু করেননি।
আশরাফুলের এই বক্তব্য অবশ্য বিশ্বাস করার
মতো লোক ক্রিকেট মহলে খুব বেশি নেই।
সেই চোরাগলি থেকে আশরাফুল নিজেকে শুধরে
নিলেও সবার হারানো বিশ্বাসটা ফেরাতে
পারবেন কি না, তা এখনই বলা কঠিন। টান টান
উত্তেজনার ম্যাচে একটি বলই যখন ম্যাচের
মোড় ঘুড়িয়ে দিতে সক্ষম, তখন কি দল
আশরাফুলের ওপর দল আস্থা রাখতে পারবে?
বিশ্বাস কি থাকবে আশরাফুল ম্যাচ জিতিয়েই
ফিরবেন?
আবার উল্টোটাও হতে পারে। আশরাফুল হয়তো
মন থেকেই চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ক্রিকেটের
স্বাভাবিক কারণেই ব্যর্থ হলেন। তখন অনেকের
মনে সন্দেহ জাগবে না তো! যে পরিস্থিতির
ভেতর দিয়ে মোহাম্মদ আমিরকে যেতে হয়েছে,
হয়তো হয় এখনো। কোনো নো বল করলে কারও
মনে প্রশ্ন উঁকি দেয়, নো বল! আবারও!
সেই বিশ্বাসের জায়গা আশরাফুল তৈরি না হয়
করলেনই, তাতেও যে তাঁর স্বপ্ন পূরণ হবে, তাও
জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। জাতীয় দলে
ফিরতে যে দুটি বিষয় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন
—ফিটনেস ও পারফরম্যান্স—তার কী অবস্থা?
এই পাঁচ বছরের মধ্যে জাতীয় দলও তো বেশ
পরিণত। দলের ব্যাটিং অর্ডারে মোটামুটি
বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই প্রতিষ্ঠিত। তাহলে
আশরাফুলের ফেরার আশা বাড়-বাড়ন্ত হয়ে
বাস্তবে অনূদিত হবে কীভাবে?
আপাতত জবাবটা খুঁজতে হচ্ছে পরিসংখ্যানের
আলোয়। ঘরোয়া ক্রিকেট দিয়ে শুরু করা যায়।
২০১৬ সালে জাতীয় ক্রিকেট লিগ দিয়ে
ঘরোয়া ক্রিকেটে ফেরেন আশরাফুল। ঢাকা
মহানগরের হয়ে ৫ ম্যাচে ২০.৫০ গড়ে করেছিলেন
১২৩ রান। সেঞ্চুরি দূরে থাক, একটি ফিফটিও
নেই। বাজে খেলায় তাঁকে নির্বাচকেরা পরে
রাখেননি ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক প্রথম
শ্রেণির ক্রিকেট বিসিএলেও।
তবে ঘরোয়া ক্রিকেটের সর্বশেষ মৌসুমটা তাঁর
জন্য জাতীয় দলে ফেরার স্বপ্নজাগানিয়া
মৌসুম। প্রথম শ্রেণির মর্যাদাসম্পন্ন জাতীয়
লিগে পেয়েছেন সেঞ্চুরির দেখা। আর ‘লিস্ট এ’
তালিকাভুক্ত ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে তো
রানের ফোয়ারা ছুটিয়েছেন। পাঁচ সেঞ্চুরি
করে নাম লিখিয়েছেন রেকর্ড বইয়ে। এ
টুর্নামেন্টে তিনি বেশির ভাগ ম্যাচেই ব্যাট
করেছেন তিনে। আর প্রিমিয়ার লিগ যেহেতু
ওয়ানডে সংস্করণ তাই বিশ্বকাপে খেলার
স্বপ্নপূরণে এ টুর্নামেন্টে তাঁর পারফরম্যান্স
বেশি করে মূল্যায়িত হবে। কিন্তু এসবই
আবেগের মায়া অঞ্জন মাখা চোখের ভাবনা।
ক্রিকেটীয় চোখ তো অন্য কথা বলে!
প্রিমিয়ার লিগের সেই পাঁচ সেঞ্চুরিতে তাঁর
দল কলাবাগান ক্রীড়াচক্র জিতেছে মাত্র
একটিতে। বাকি চার ম্যাচেই তারা হেরেছে।
যে ম্যাচটা কলাবাগান জিতেছে সে ম্যাচে
১০২ রানের ইনিংস খেলতে আশরাফুল খেলেছেন
১৩৬ বল। আর সেই ম্যাচেই কলাবাগানের
তাসামুল হক খেলেছেন ১১৫ বলে ১০৬ রানের
ইনিংস। অবদানটা তাহলে কার বেশি?
আশরাফুলের সেই পাঁচ সেঞ্চুরি কিন্তু
কলাবাগানের অবনমন রুখতে পারেনি।
শুধু তাই নয়, প্রিমিয়ার লিগের গত টুর্নামেন্টে
ন্যূনতম ৫০০ রান করা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে
আশরাফুলের স্ট্রাইকরেট তলানির দিকে।
খোলাসা করে বললে আশরাফুলের (৭৪.১৩
স্ট্রাইক রেট) কম স্ট্রাইক রেট ছিল মাত্র
তিনজনের। তবে এসবের চেয়েও নির্মম
বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের ঘরোয়া
ক্রিকেটের মানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক
ক্রিকেটের আকাশ-পাতাল ফারাক। এই
বাস্তবতাটা মাঝে-মধ্যেই স্বীকার করে বসেন
স্বয়ং জাতীয় দলের ক্রিকেটারেরাই! ঘরোয়া
ক্রিকেটে রানের বন্যা ছোটানো তুষার
ইমরানকে বিবেচনায় নেন না নির্বাচকেরা।
এরপরও কিন্তু আশা থাকে। কারণ মানুষ আশায়
বাঁচে। ক্রিকেটারেরা তো বটেই। আশরাফুলের
নিজের ভাষ্য অনুযায়ী, এই আশার বলেই গত দুই
মাসে আট-নয় কেজির মতো ওজন কমিয়েছেন।
তা না হয় হলো, কিন্তু জাতীয় দলে আশরাফুল
কোন পজিশনে খেলবেন সেটিও ভেবে দেখা
দরকার।
ওপেনিংয়ে সঙ্গতকারণেই সুযোগটা নেই।
তামিম ইকবাল ‘অটোমেটিক চয়েস’। তাঁর সঙ্গে
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেলানো হচ্ছে লিটন দাস আর
সৌম্য সরকারকে। দুজনের ফর্ম ধারাবাহিক না
হলেও ২০১৯ বিশ্বকাপে ছত্রিশে পা রাখা
কোনো ব্যাটসম্যানকে নিশ্চয়ই ইংলিশ
কন্ডিশনে ওপেন করতে পাঠানোর ঝুঁকি নেবে
না টিম ম্যানেজমেন্ট। আর সেই ব্যাটসম্যানটির
যদি আগের পাঁচ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে
খেলার অভিজ্ঞতা না থাকে তাহলে?
তাহলে আশরাফুলকে আগে যে পজিশনে বেশি
দেখা গেছে তিন নম্বরে পরীক্ষা করে দেখা
যেতে পারে? পরীক্ষা! সেটিও আবার
বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্টে? আর তিনে তো
এ বছরের জানুয়ারিতে ত্রিদেশীয় সিরিজ
থেকে সাকিব আল হাসান বেশ ধারাবাহিক।
ওয়ানডেতে এই পজিশনে ৯ ম্যাচে ব্যাটিং করা
সাকিবের গড় ৪২.৪৪। আর একই পজিশনে ৫২
ম্যাচে আশরাফুলের ব্যাটিং গড় ২০.৫০।
চার নম্বর পজিশন নিয়ে কথা না বলাই ভালো।
বাংলাদেশ দলের ব্যাটিংয়ে ‘মেরুদণ্ড’ খ্যাত
মুশফিকুর রহিমের জন্য জায়গাটা মোটামুটি
‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।’ তারপরও এই পজিশনে
আশরাফুলের ব্যাটিং গড় বলে রাখা ভালো। ৫১
ম্যাচে ২৪.৯৫। যেখানে মুশফিকের এই পজিশনে
৭২ ম্যাচে ব্যাটিং গড় ৩৮.৬৮। বাকি রইল পাঁচ,
ছয়, সাত নম্বর পজিশন। পাঁচ নম্বরে ২৪ ম্যাচ
খেলা আশরাফুলের ব্যাটিং গড় ২৬.১৫। ছয়ে ১৫
ম্যাচে ২৯.৫৫। সাতে ৬ ম্যাচে ২২.৬৬।
এই পাঁচ, ছয়, সাতের মধ্যে মাহমুদউল্লাহ তো
‘অটোমেটিক চয়েস’। তাঁর পাশাপাশি
মোসাদ্দেক, মেহেদি আর সাব্বিরের মতো
তারুণ্যে ভরসা রাখছে টিম ম্যানেজমেন্ট।
বোঝাই যাচ্ছে ভবিষ্যতের ভাবনাটা মাথায়
রেখেই এই তিন তরুণের ওপর ভরসা রাখা হচ্ছে।
তাই অনেকের কাছেই আশরাফুলের ফেরার
আশাকে ‘মিছে আশা’ বলে মনে হতেই পারে।
২০১৯ বিশ্বকাপ অন্তত আশরাফুলের জন্য অনেক
ধূসর এক বাস্তবতা। টেস্ট ক্রিকেটে ফেরার
জন্যও পাড়ি দিতে হবে কঠিন পথ।

Post a Comment

0 Comments